Skip to main content

ভাঙ্গা আয়নায় প্রতিবিম্ব - সোমনাথ সিংহ রায়

 দ্যুতিময় চারমিনারের প্যাকেট থেকে শেষ সিগারেটটা বার করে ধরাতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখলো। ওর শালপ্রাংশু দেহটা ভাঙ্গা আয়নায় কেমন যেন ভাঙাচোরা লাগছে। ঘরের আলো নিভিয়ে রেখেছে দ্যুতিময়। পুরোনো আমলের খড়খড়ি লাগানো বড় জানালাটা হাট করে খোলা। রাস্তার ওপারে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দোতলার এই ঘরটা একটা আলো আধাঁরির পরিবেশ তৈরি করেছে।

আড়াআড়ি ভাবে আয়নায় পড়া আলোয় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে দ্যুতিময় ফিরে গেল প্রায় অর্ধশত বছর আগে। তখন ও কলেজে পড়ে আর  ছাত্র রাজনীতি করে। প্রকাশ্যে নয় গোপনে। ধরা পড়লে ছবি হয়ে যেতে হবে। একবার প্রায় ধরা পড়ে যেতে যেতে উপস্থিত বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায়। তখন সন্ধ্যের পর রাস্তার বাতি জ্বললে এমনই একটা আলো আঁধারের পরিবেশ সৃষ্টি হতো। না জ্বললে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সময়টা সাত-এর দশক। 


সিগারেটের খালি প্যাকেটটা দুমড়ে মুচড়ে পেটো ছোঁড়ার ভঙ্গিমায় ছুঁড়ে মারলো যাতে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। ছোঁড়াটা একটু জোরে হয়ে গেলো। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গরাদে  লেগে ফিরে এলো ওর পায়ের কাছে। আবার চেষ্টা করলো এবার সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলো। ভিতর থেকে একটা রাগ গুমরে বেরোতে চাইছে। সে এতটা ব্যর্থ ! এতটা ভুল ওর নিশানা ! নীচু হয়ে দলাপাকানো প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিয়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেল ছুঁড়ে রাস্তা পার করে ফেলতে গিয়ে চোখে পড়লো কালো রঙের সেই গাড়ি। পুলিশ লেখা। দ্যুতিময়ের সমস্ত শরীর জুড়ে একটা শিরশিরে ভাব অর্ধশতক বছর পরেও বয়ে গেল। 


ওই কালো রঙের গাড়িটা দেখলে একটা ভয়, একরাশ ঘৃণা আছড়ে পড়ে। দ্যুতিময় চিৎকার করে বলতে চাইলো, "শঙ্কর পালা। দেবু পালা। প্রতীক পালা।"

কে যেন ওর গলাটা টিপে ধরেছে। গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুচ্ছে না, একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ ছাড়া। উল্টোদিক থেকে আরো একটা, আরো একটা। সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। গাড়ি থেকে নেমে আসছে উর্দিধারীরা রাইফেল হাতে। দরজায় দরজায় ভারী বুটের লাথি। গুলির আওয়াজ। রক্ত, তাজা  রক্ত। কালো পিচের  রাস্তা লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। একে একে তরতাজা যুবকগুলোকে পা ধরে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে হিঁচড়তে হিঁচড়তে নিয়ে গিয়ে ভ্যানে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। তারপর যেমন এসেছিলো চুপিসাড়ে তেমনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কোম্বিং শেষ। রাস্তায় পড়ে আছে দেশদ্রোহীর তাজা রক্ত ! শঙ্কর, দেবু, প্রতীককে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন খবরের কাগজের তৃতীয় পৃষ্ঠার একদম কোনার দিকে ছোট্টো করে একটা খবর বেরিয়েছিল "পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সমাজ বিরোধীর মৃত্যু"। 

সেইদিন থেকে দ্যুতিময় হারিয়েছে তার সবচেয়ে কাছের তিন বন্ধুকে। ওরা ছিল সব দিক দিয়ে এই বরানগর-কাশীপুরের সেরা ছেলে। 

ওদের অপরাধ ওরা মানুষের কথা ভাবতো। একটু অন্য ভাষায় কথা বলতো। কথা বলার সময় ওদের চোখগুলো চকচক করে উঠতো। "শুয়ারের বাচ্ছা ওরা দেশদ্রোহী ! আর তোমরা দেশপ্রেমিক !" জানালার গরাদটা হাত দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে চাপা স্বরে গুমরিয়ে উঠলো দ্যুতিময়। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা ঘৃণা, ক্রোধ নতুন করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলায় উঠে আসা একদলা গয়ার  জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে আবার আয়নার কাছে এসে নিজেকে দেখলো। ভাঙ্গা কাঁচে নিজের বিকৃত চেহারা দেখে একটা ভেংচি কাটলো আর বিড়বিড় করে বললো,"শালা বেঁচে আছি !" 


আজ স্বাধীনতা দিবস। উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দায় লটকানো পতাকা ভাঙ্গা-আয়নায় উল্টানো আর অমসৃণ লাগছে। দ্যুতিময় ভাবলো অবিকল ওর মতো ! ভাঙ্গাচোরা অস্তিত্ব নিয়ে টিঁকে যাওয়া। পঞ্চাশ কি সত্তরটা বছর স্মৃতি বয়ে যাওয়া। বেঁচে থাকা !

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহার (প্রসঙ্গ ঃ 'বিদ্রোহী') ----বিষ্ণুপদ চৌধুরী

 পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করে সাহিত্য সৃষ্টি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তা দৃষ্ট। বলা বাহুল্য,  সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চাইতে কবিতাতেই এই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার বেশি। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি পৌরাণিক নানান অনুষঙ্গকে কবিরা ব্যবহার করছেন।     আমরা আজ আলোচনা করব নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের মেলবন্ধন কিভাবে তাঁর কবিতাকে সামগ্রিকতা দান করেছে। নজরুল তাঁর অনেক কবিতাতেই এই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথকে এক নতুন ভাবে রূপদান করেছেন।  তিনি পুরাণের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কবিতায় স্থাপন করতে চেয়েছেন। বলা যেতে পারে,  পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার তাঁর কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।  তিনি হিন্দু,  মুসলিম,  গ্রীক প্রভৃতি পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্য কবিতায় এক নতুনভাবে ব্যবহার করেছেন। আমরা সেগুলোই এখন আলোচনা করে দেখে নেবো।        নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহারকে আমরা কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে নেবো। ১। ভারতীয় মিথ-পুরাণের ব্যবহার। ২। বা...

শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কিছু স্মৃতি কথা : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে - দীপান্বিতা মন্ডল

কবে থেকে যে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার অনুরাগী পাঠিকা হয়ে পড়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে না । সেই কোন ছোট্টোবেলা থেকে বাপির মুখে ওঁর নাম অসংখ্যবার শুনেছি নানা কারনে । বাপিরও প্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় - বাপির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম " হাঁসুলি বাঁকের উপকথা"র কাহিনী । বাপিদের ছাত্রাবস্থায় ঐ উপন্যাস প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাংলায় কিভাবে তিনি আপামর বাঙালী পাঠকদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন শুনতাম সে গল্পও । রাঙামাটির রস রঙ রূপ গন্ধ বর্ণ , স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষদের অকৃত্রিম জীবনের ছবি এঁকে বাংলা সাহিত্যে যে নতুন মণিমানিক্যের ভান্ডারটি সৃষ্টি করলেন তার হদিস প্রথম পেয়েছিলাম বাপির কাছ থেকেই। গল্প শুনতাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় বাপিরা বন্ধুরা মিলে তাঁর টালা পার্কের বাড়ীতে ছুটির দিনে ছুটত নতুন গল্পের স্বাদ নিতে নয়ত তাঁর কোন গল্পের ওপর ভিত্তি করে উত্তম সুচিত্রার পরের ছবিটা হতে চলেছে তার কাহিনী শুনতে । তাঁর প্রতি এ হেন ভালোবাসাই পরবর্তীকালে আমার মধ্যেও যে সঞ্চারিত হয়নি একথা না বললে সত্যের অপলাপ করা হবে । তাই দুর্গাপুরে পোস্টিং থাকার ...

প্রচ্ছদ ( অক্টোবর, ২০২০ )

  সকলের আশীর্বাদ এবং সহযোগিতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশিত হলো বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর উদ্যোগে পদচিহ্ন সাহিত্য পত্রিকা ( তারাশঙ্কর সাহিত্যসভার মুখপত্র )  ম্যাগাজিনটি পড়ার নিয়মাবলী - ১| সম্পূর্ণ ম্যাগাজিনটি পড়তে ক্লিক করুন বামদিকের উপরে থাকা " Home " সুইচ এ । তারপর আপনারা একটি একটি করে দেখতে পাবেন এবারের সংখ্যার পোস্ট গুলি । যে লেখাটি পড়তে চান " Read more " বাটনে ক্লিক করলে সবটা পড়তে পারবেন। ২|  পড়ার পর নিজের অভিজ্ঞতা জানান নিচে কমেন্ট বক্সে । আর " Share " বাটন এ ক্লিক করে লিংক কপি করে নিয়ে নিজের মত করে এই ম্যাগাজিনটি সবাইকে পড়তে সুযোগ করে দিন। ৩|      এই ম্যাগাজিনের সমস্ত পোস্টের কপিরাইট তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা এবং লেখকের নামে রেজিস্টার্ড । বিনা অনুমতিতে এই ম্যাগাজিনের কোনো লেখা ব্যবহার বারন । ( Copyright act 2019-20 )        ধন্যবাদান্তে - ডঃ উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় ( সম্পাদক , বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী ) , সুনীল পাল ( সভাপতি , তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা ) , অর্ঘ্য মুখার্জ্জী ( সম্পাদক, তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা )