দ্যুতিময় চারমিনারের প্যাকেট থেকে শেষ সিগারেটটা বার করে ধরাতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখলো। ওর শালপ্রাংশু দেহটা ভাঙ্গা আয়নায় কেমন যেন ভাঙাচোরা লাগছে। ঘরের আলো নিভিয়ে রেখেছে দ্যুতিময়। পুরোনো আমলের খড়খড়ি লাগানো বড় জানালাটা হাট করে খোলা। রাস্তার ওপারে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দোতলার এই ঘরটা একটা আলো আধাঁরির পরিবেশ তৈরি করেছে।
আড়াআড়ি ভাবে আয়নায় পড়া আলোয় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে দ্যুতিময় ফিরে গেল প্রায় অর্ধশত বছর আগে। তখন ও কলেজে পড়ে আর ছাত্র রাজনীতি করে। প্রকাশ্যে নয় গোপনে। ধরা পড়লে ছবি হয়ে যেতে হবে। একবার প্রায় ধরা পড়ে যেতে যেতে উপস্থিত বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায়। তখন সন্ধ্যের পর রাস্তার বাতি জ্বললে এমনই একটা আলো আঁধারের পরিবেশ সৃষ্টি হতো। না জ্বললে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সময়টা সাত-এর দশক।
সিগারেটের খালি প্যাকেটটা দুমড়ে মুচড়ে পেটো ছোঁড়ার ভঙ্গিমায় ছুঁড়ে মারলো যাতে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। ছোঁড়াটা একটু জোরে হয়ে গেলো। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গরাদে লেগে ফিরে এলো ওর পায়ের কাছে। আবার চেষ্টা করলো এবার সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলো। ভিতর থেকে একটা রাগ গুমরে বেরোতে চাইছে। সে এতটা ব্যর্থ ! এতটা ভুল ওর নিশানা ! নীচু হয়ে দলাপাকানো প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিয়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেল ছুঁড়ে রাস্তা পার করে ফেলতে গিয়ে চোখে পড়লো কালো রঙের সেই গাড়ি। পুলিশ লেখা। দ্যুতিময়ের সমস্ত শরীর জুড়ে একটা শিরশিরে ভাব অর্ধশতক বছর পরেও বয়ে গেল।
ওই কালো রঙের গাড়িটা দেখলে একটা ভয়, একরাশ ঘৃণা আছড়ে পড়ে। দ্যুতিময় চিৎকার করে বলতে চাইলো, "শঙ্কর পালা। দেবু পালা। প্রতীক পালা।"
কে যেন ওর গলাটা টিপে ধরেছে। গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুচ্ছে না, একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ ছাড়া। উল্টোদিক থেকে আরো একটা, আরো একটা। সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। গাড়ি থেকে নেমে আসছে উর্দিধারীরা রাইফেল হাতে। দরজায় দরজায় ভারী বুটের লাথি। গুলির আওয়াজ। রক্ত, তাজা রক্ত। কালো পিচের রাস্তা লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। একে একে তরতাজা যুবকগুলোকে পা ধরে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে হিঁচড়তে হিঁচড়তে নিয়ে গিয়ে ভ্যানে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। তারপর যেমন এসেছিলো চুপিসাড়ে তেমনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কোম্বিং শেষ। রাস্তায় পড়ে আছে দেশদ্রোহীর তাজা রক্ত ! শঙ্কর, দেবু, প্রতীককে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন খবরের কাগজের তৃতীয় পৃষ্ঠার একদম কোনার দিকে ছোট্টো করে একটা খবর বেরিয়েছিল "পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সমাজ বিরোধীর মৃত্যু"।
সেইদিন থেকে দ্যুতিময় হারিয়েছে তার সবচেয়ে কাছের তিন বন্ধুকে। ওরা ছিল সব দিক দিয়ে এই বরানগর-কাশীপুরের সেরা ছেলে।
ওদের অপরাধ ওরা মানুষের কথা ভাবতো। একটু অন্য ভাষায় কথা বলতো। কথা বলার সময় ওদের চোখগুলো চকচক করে উঠতো। "শুয়ারের বাচ্ছা ওরা দেশদ্রোহী ! আর তোমরা দেশপ্রেমিক !" জানালার গরাদটা হাত দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে চাপা স্বরে গুমরিয়ে উঠলো দ্যুতিময়। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা ঘৃণা, ক্রোধ নতুন করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলায় উঠে আসা একদলা গয়ার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে আবার আয়নার কাছে এসে নিজেকে দেখলো। ভাঙ্গা কাঁচে নিজের বিকৃত চেহারা দেখে একটা ভেংচি কাটলো আর বিড়বিড় করে বললো,"শালা বেঁচে আছি !"
আজ স্বাধীনতা দিবস। উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দায় লটকানো পতাকা ভাঙ্গা-আয়নায় উল্টানো আর অমসৃণ লাগছে। দ্যুতিময় ভাবলো অবিকল ওর মতো ! ভাঙ্গাচোরা অস্তিত্ব নিয়ে টিঁকে যাওয়া। পঞ্চাশ কি সত্তরটা বছর স্মৃতি বয়ে যাওয়া। বেঁচে থাকা !
অভিনন্দন!
ReplyDelete