Skip to main content

নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহার (প্রসঙ্গ ঃ 'বিদ্রোহী') ----বিষ্ণুপদ চৌধুরী

 পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করে সাহিত্য সৃষ্টি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তা দৃষ্ট। বলা বাহুল্য,  সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চাইতে কবিতাতেই এই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার বেশি। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি পৌরাণিক নানান অনুষঙ্গকে কবিরা ব্যবহার করছেন।


    আমরা আজ আলোচনা করব নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের মেলবন্ধন কিভাবে তাঁর কবিতাকে সামগ্রিকতা দান করেছে। নজরুল তাঁর অনেক কবিতাতেই এই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথকে এক নতুন ভাবে রূপদান করেছেন।  তিনি পুরাণের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কবিতায় স্থাপন করতে চেয়েছেন। বলা যেতে পারে,  পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার তাঁর কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।  তিনি হিন্দু,  মুসলিম,  গ্রীক প্রভৃতি পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্য কবিতায় এক নতুনভাবে ব্যবহার করেছেন। আমরা সেগুলোই এখন আলোচনা করে দেখে নেবো।


       নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহারকে আমরা কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে নেবো।


১। ভারতীয় মিথ-পুরাণের ব্যবহার।


২। বাংলার দেশজ মিথ তথা লোক-পুরাণের ব্যবহার।


৩। ইউরোপীয় মিথের ব্যবহার।


৪। ইসলামী মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহার।


৫। মধ্যপ্রাচ‍্যীয় মিথিক উৎসের ব্যবহার।


  .  নজরুলের প্রথম পর্যায়ের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়।  আসলে তাঁর প্রথম পর্যায়ের কবিতায় ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের এক চিত্র,  সমাজে শোষিত অবহেলিত মানুষের কথা চরমভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়।  তাই,  অবরুদ্ধ ও শোষিত সমাজের তারুণ্য ও পৌরুষের প্রতীক হিসেবেই মিথ-উৎসকে ব্যবহার করেছেন তিনি।  শিব, অর্জুন, দুর্বাসা, ভীম, বিশ্বামিত্র,  জমদগ্নি,  বিষ্ণু,  পরশুরাম,  বলরাম, দুঃশাসন,  ভৃগু,  প্রহ্লাদ,  অভিমন্যু,  চণ্ডী,  দ্রৌপদী প্রভৃতি মিথিক চরিত্র বিচিত্র অভিপ্রায়ে একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর কাব্যে।  যেমন- 


১। "মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ,  আমি সাইক্লোন,  আমি ধ্বংস ! "


২। "আমি হোমশিখা,  আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,  আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত,  আমি অগ্নি। "


৩। "আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,


আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব। "


৪। "আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,


নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব,  আনিব শান্তি শান্ত উদার।"


৫। "আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান- বুকে এঁকে দিই পদ চিহ্ন ;


আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন। "


("বিদ্রোহী" - অগ্নিবীণা)


৬। "আজ ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য পাগল,


ঐ ভাঙলো আগল ওরে ভাঙলো আগল!


আজ বিষ্ণু-ভালে জ্বলে রক্ত -টীকা!


শুধু অগ্নি -শিখা ধূ ধূ অগ্নি-শিখা,


শোভে করুণার ভালে লাল রক্ত টীকা !"


(''জাগৃহি" - বিষের বাঁশি) 


      উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোতে মূলতঃ ধ্বংস ও সৃষ্টির অনুষঙ্গবাহী মিথের চিত্রকল্পময় ব্যবহার ঘটেছে।  ভারতীয় মিথ নজরুলের কাব্য কবিতায় যে শিল্পবলয় রচনা করেছে,  তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নটরাজ শিব। এই শিব বিভিন্ন নামধারী। কখনো তা রুদ্র,  ভৈরব,  দিগম্বর,  ধূর্জটি,  ব্যোমকেশ কখনো আবার পিনাকী, ত্রিশূলী, শিব, মহেশ, শংকর, নটরাজ প্রভৃতি৷ নটরাজ শিবের এই বিচিত্র ভাববস্তুর রূপান্তরিত ইমেজ তাঁর কবিতায় বার বার ফিরে এসেছে।  এগুলো ভারতীয় পৌরাণিক মিথ। আবার, চণ্ডীর রূপকল্পনায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজের আর্কেটাইপ আলোড়িত করেছে কবিচিত্তকে।  শিব যেমন তাঁর অনুধ্যানে ধ্বংস ও সৃষ্টির বিচিত্র অনুভবের প্রতীক, তেমনি চণ্ডীর বিচিত্র রূপ-কল্পনার মধ্যেও এই বোধের প্রকাশ ঘটেছে। 


•   বাংলার দেশজ মিথ তথা লোকপুরাণকে দেশের মৃত্তিকামূল থেকে আহরণ করেছিলেন নজরুল। আর তারই প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায়। 'বিদ্রোহী' কবিতার একজায়গায় তিনি লিখছেন,  "আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী"। এই শ্যাম বা কৃষ্ণ আমাদের দেশজ বাংলাদেশের কৃষ্ণ বা শ্যাম।


•   ইউরোপীয় মিথের বহুল প্রয়োগ না থাকলেও দুএকটি অব্যর্থ ব্যবহার তাঁর কাব্য কবিতায় লক্ষ্যণীয়। যেমন- 


"আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরি 


মহাসিন্ধু উতলা ঘুম ঘুম 


ঘুম চুমু দিয়ে করে নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম।"


("বিদ্রোহী")


এখানে চিত্রকল্প হিসেবে মিথের প্রয়োগ ঘটেছে বিদ্রোহী কবির জাগরচৈতন্যের বিচিত্র অভীপ্সার অনুষঙ্গ হিসেবে।


• মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসপুঞ্জ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শের প্রাণময় উৎসকে নজরুল সৃষ্টিশীল চেতনার অনুষঙ্গে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলমান সমাজের সমকালীন চেতনায় নবজাগরণের যে উদ্দীপনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন কবি, সেই জাগ্রত প্রাণধর্মের সাথে সাধর্ম্যসূত্রেই তিনি পরিভ্রমণ করেছেন ইসলামী ঐতিহ্যের বিস্তৃত পটভূমিতে।  বিশ্বাসের সাথে শিল্পনির্মিত এই অন্তর্ময় সংযোগ বাংলা কাব্যধারায় উন্মোচন করেছে নতুন সম্ভাবনার দিগন্তলোক।


•    ইসলামী ঐতিহ্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নজরুলের শিল্পী - চৈতন্য  অভিপ্রায়ের বৈচিত্র্যে বিশিষ্ট।  অবরুদ্ধ সমাজের মুক্তিআকাঙ্ক্ষায় জাগ্রত কবিচৈতন্য বিদ্রোহ ও প্রতিবাদকে যখন কাব্যরূপ দান করেছে,  তখন ঐতিহ্য অনুষঙ্গও অনুরূপ ভাবব্যঞ্জনায় অভিব্যক্ত হয়েছে।  'বিদ্রোহী' কবিতার একজায়গায় বলছেন - 


১। "আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার"


২। "ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি।"


এভাবেই নজরুল তাঁর বিদ্রোহবোধের অনুষঙ্গী ঐতিহ্য উৎসকে প্রাণময় কাব্যবস্তুতে পরিণত করেছেন।  জাগরণকামী বাঙালী মুসলমানের আত্মসন্ধান ও সত্তাসন্ধানের পটভূমিতে ঐতিহ্যের গৌরবময় অনুভব সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। "বিষের বাঁশী" কাব্যের 'ফাতেহা-ই-দোয়াজ দহম' -এর আবির্ভাব ও তিরোভাব অংশদ্বয় ইসলামী ঐতিহ্যের মৌল বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত কবিতা। "অগ্নিবীণা" র 'খেয়াপারের তরণী', 'কোরবাণী' এবং 'মোহররম' কবিতায় কবির ঐতিহ্য বোধের সাথে জীবনার্থের মৌল অভীপ্সার সমীকরণ ঘটেছে।


      নজরুলের কবিচৈতন্য মিথ-ঐতিহ্যের এই বহুমাত্রিক অঙ্গীকার নিঃসন্দেহে  তাৎপর্যময় এবং অভূতপূর্ব শিল্প এষণায় গৌরবমণ্ডিত।  মৌল স্বভাবে রোমান্টিক নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজমানসের বিচিত্র অভীপ্সা ও বিশ্বাসের সাথে নিজ জীবনবোধকে সমন্বিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এবং জাতি ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতন-অবচেতনের বিচিত্র উৎসলোকে তাঁর সঞ্চরণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।  যার ফলে, এককেন্দ্রীয় লক্ষ্যমুখী চেতনার ঐকান্তিকতাই হয়েছে নজরুলের মিথ চয়নের প্রেরণা শক্তি।  


     ঐতিহ্যবোধের ক্ষেত্রেও তিনি স্পর্শ করেছেন সমষ্টি চৈতন্যের ইতিবাচক প্রান্তসমূহ। এবং বোধের পরিপূর্ণতা সন্ধানের প্রশ্নে তিনি কখনো হয়েছেন বিশ্বচারী। নজরুলের জীবনবোধের কেন্দ্রীয় মীমাংসাটি হল শোষণ বঞ্চনা নিপীড়নের হাত থেকে মানবাত্মার মুক্তি আকাঙ্ক্ষা। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতিশোষণ, শ্রেণিশোষণ, ধর্মশোষণের বিরুদ্ধে মানুষের শৃঙ্খলিত বিবেককে জাগ্রত করাই ছিল তাঁর জীবনমন্ত্র। জীবনার্থের এই বৈশিষ্ট্যই নজরুলের মিথ ঐতিহ্য চেতনাকে করেছে মানবমুখী জীবনান্বেষায় ভাস্বর।

Comments

Popular posts from this blog

শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কিছু স্মৃতি কথা : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণে - দীপান্বিতা মন্ডল

কবে থেকে যে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার অনুরাগী পাঠিকা হয়ে পড়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে না । সেই কোন ছোট্টোবেলা থেকে বাপির মুখে ওঁর নাম অসংখ্যবার শুনেছি নানা কারনে । বাপিরও প্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় - বাপির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম " হাঁসুলি বাঁকের উপকথা"র কাহিনী । বাপিদের ছাত্রাবস্থায় ঐ উপন্যাস প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাংলায় কিভাবে তিনি আপামর বাঙালী পাঠকদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন শুনতাম সে গল্পও । রাঙামাটির রস রঙ রূপ গন্ধ বর্ণ , স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষদের অকৃত্রিম জীবনের ছবি এঁকে বাংলা সাহিত্যে যে নতুন মণিমানিক্যের ভান্ডারটি সৃষ্টি করলেন তার হদিস প্রথম পেয়েছিলাম বাপির কাছ থেকেই। গল্প শুনতাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় বাপিরা বন্ধুরা মিলে তাঁর টালা পার্কের বাড়ীতে ছুটির দিনে ছুটত নতুন গল্পের স্বাদ নিতে নয়ত তাঁর কোন গল্পের ওপর ভিত্তি করে উত্তম সুচিত্রার পরের ছবিটা হতে চলেছে তার কাহিনী শুনতে । তাঁর প্রতি এ হেন ভালোবাসাই পরবর্তীকালে আমার মধ্যেও যে সঞ্চারিত হয়নি একথা না বললে সত্যের অপলাপ করা হবে । তাই দুর্গাপুরে পোস্টিং থাকার ...

প্রচ্ছদ ( অক্টোবর, ২০২০ )

  সকলের আশীর্বাদ এবং সহযোগিতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশিত হলো বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর উদ্যোগে পদচিহ্ন সাহিত্য পত্রিকা ( তারাশঙ্কর সাহিত্যসভার মুখপত্র )  ম্যাগাজিনটি পড়ার নিয়মাবলী - ১| সম্পূর্ণ ম্যাগাজিনটি পড়তে ক্লিক করুন বামদিকের উপরে থাকা " Home " সুইচ এ । তারপর আপনারা একটি একটি করে দেখতে পাবেন এবারের সংখ্যার পোস্ট গুলি । যে লেখাটি পড়তে চান " Read more " বাটনে ক্লিক করলে সবটা পড়তে পারবেন। ২|  পড়ার পর নিজের অভিজ্ঞতা জানান নিচে কমেন্ট বক্সে । আর " Share " বাটন এ ক্লিক করে লিংক কপি করে নিয়ে নিজের মত করে এই ম্যাগাজিনটি সবাইকে পড়তে সুযোগ করে দিন। ৩|      এই ম্যাগাজিনের সমস্ত পোস্টের কপিরাইট তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা এবং লেখকের নামে রেজিস্টার্ড । বিনা অনুমতিতে এই ম্যাগাজিনের কোনো লেখা ব্যবহার বারন । ( Copyright act 2019-20 )        ধন্যবাদান্তে - ডঃ উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় ( সম্পাদক , বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী ) , সুনীল পাল ( সভাপতি , তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা ) , অর্ঘ্য মুখার্জ্জী ( সম্পাদক, তারাশঙ্কর সাহিত্যসভা )