কবে থেকে যে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার অনুরাগী পাঠিকা হয়ে পড়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে না । সেই কোন ছোট্টোবেলা থেকে বাপির মুখে ওঁর নাম অসংখ্যবার শুনেছি নানা কারনে । বাপিরও প্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় - বাপির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম " হাঁসুলি বাঁকের উপকথা"র কাহিনী । বাপিদের ছাত্রাবস্থায় ঐ উপন্যাস প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাংলায় কিভাবে তিনি আপামর বাঙালী পাঠকদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন শুনতাম সে গল্পও । রাঙামাটির রস রঙ রূপ গন্ধ বর্ণ , স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষদের অকৃত্রিম জীবনের ছবি এঁকে বাংলা সাহিত্যে যে নতুন মণিমানিক্যের ভান্ডারটি সৃষ্টি করলেন তার হদিস প্রথম পেয়েছিলাম বাপির কাছ থেকেই। গল্প শুনতাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় বাপিরা বন্ধুরা মিলে তাঁর টালা পার্কের বাড়ীতে ছুটির দিনে ছুটত নতুন গল্পের স্বাদ নিতে নয়ত তাঁর কোন গল্পের ওপর ভিত্তি করে উত্তম সুচিত্রার পরের ছবিটা হতে চলেছে তার কাহিনী শুনতে । তাঁর প্রতি এ হেন ভালোবাসাই পরবর্তীকালে আমার মধ্যেও যে সঞ্চারিত হয়নি একথা না বললে সত্যের অপলাপ করা হবে । তাই দুর্গাপুরে পোস্টিং থাকার সময় বাপি নিয়ম করে বীরভূমে বছরে কয়েকবার আমাদের নিয়ে আসতই - বসন্তোৎসব , পৌষমেলা , জয়দেব কেন্দুলি মেলা আর হ্যাঁ নিয়ে যেত লাভপুরে- বাপির প্রিয় সাহিত্যিক তারাশঙ্করের জন্মভিটে দর্শন করাবার জন্য । তাই তারাশঙ্কর আর লাভপুর আমার কাছে চেনা জানা সেই ছোট্টোবেলা থেকেই । তখন এর মাহাত্ম্য বোঝার মতন বোধ বা বুদ্ধি কিছুই হয়নি । পরে বড় হয়ে আস্তে আস্তে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টির মধ্যে যত ডুব দিতে লাগলাম তত বেশী করে চিনতে শুরু করলাম রাঙামাটির দেশকে । আমাদের পৈত্রিক দেশও যে আর এক রাঙামাটির স্থান - বাঁকুড়া । তাই বোধয় এই একাত্মতা ! তারাশঙ্করের রচনার মধ্যে দিয়েই মনের ভিতরে প্রোথিত হতে থাকল মাটির ভাষা , দেশজ লোক সংস্কৃতি , দেশজ গ্রামীন মানুষজন , তাদের জীবন জীবিকার উপাখ্যান , তাদের দুঃখ দুর্দশার বারমাস্যা এবং তার মধ্যেই বেঁচে থাকার কঠিন লড়াইয়ের কথা । বইয়ের পাতার হাঁসুলীবাঁক , করালী , বানোয়ারি , পাখি , রাইকমল , ঠাকুরঝি , বেদেনী , নাগিন কন্যা , নিতাই কবিয়াল , বিশ্বম্ভর রায় , জীবনমশাই, দেবু মাষ্টাররা কখন মূর্ত হয়ে আমার মনের ভিতরে ঠাঁই করে নিয়েছিল তা টেরই পাইনি । বড় আপনার মনে হত লেখককে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে । নিজেও ঐ মাটির ভূমিপুত্র বলে এবং ব্যক্তি জীবনে নিজস্ব চেনা জানা পরিধির মানুষদের নিয়ে তাঁর লেখনী ভরে তুলেছিলেন বলেই বোধয় তার সৃষ্ট সাহিত্য শুধুমাত্র কাগজের পাতায় বন্দী থাকেনি । তাদের অবস্থান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ছত্রে । কত কত বাংলা ছায়াছবি সমৃদ্ধ হয়েছে তার লেখা গল্প উপন্যাসে যা দেখে মন বিহ্বল হয়ে যেত সেই সময় । সময়ের চাকায় বাপির বদলি হবার দরুন লাভপুরে আসা আগের থেকে কমে এসেছিল । তাও মাঝে মধ্যে স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে বীরভূমে এলেই চেষ্টা করতাম তারাশঙ্করের জন্মস্থানে একবার ঢুঁ মারার । তাঁর বৈঠকখানা দর্শন, তাঁর নিজের হাতের কাটুমকুটুম দেখা , আকাদেমী পুরস্কারের স্মারকের কপি দেখার সৌভাগ্য , উপন্যাসের জীবন্ত চরিত্রের সাক্ষাৎ করা , কুঁয়ে নদীর হাঁসুলী বাঁক দেখার আনন্দ , ছোটো রেল গাড়ী দেখার মজা ( ইকে বিকে ট্রেন বলা হত তখন মজা করে ) -- কত কতবার দেখেছি এই সব, তার হিসাব দিই কি করে আজ ! ফিরে আসার সময় সে কি রকম এক মন খারাপ আচ্ছন্ন করে ফেলত তখন সমগ্র সত্তাটাকে আমার তা বলে বোঝাতে পারব না । অল্প বয়সের মানসিক অপরিপক্কতা হবে বোধয় !
অন্তর্যামী এই টানের কথা জানতেন । তাই হয়ত বহু বছর বাদে একেবারে অযাচিত ভাবে আমার কর্মসূত্রে আমাকে নিয়ে এলেন বীরভূমে - বোলপুর মহকুমার দায়িত্বে । প্রথম পোস্টিং চাকরি জীবনে । লাভপুর ব্লক তখন আমার জুরিসডিক্শনে । কি আনন্দ - এ যে মেঘ না চাইতেই জল! আবার বিনা বাধায় , বিনা কারনে আমার ইচ্ছামতন যেতে পারব তারাশঙ্করের জন্মস্থান দর্শনে । ঘুরে বেড়াতে পারব মনের আনন্দে তাঁর সৃষ্টি সূত্রের উৎধারায় ।
নানান অনুষ্ঠান উপলক্ষে লাভপুরে যাওয়া তখন আমার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গেছিল । তার প্রধান কারন তারাশঙ্কর এবং লাভপুরের সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল । পরিচিতি বাড়ছিল স্থানীয় মানুষজনদের সঙ্গেও । এর মধ্যে প্রধান যে অনুষ্ঠানটির জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম - তা হল ৮ই শ্রাবণ- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম তিথি । আমার প্রিয় সাহিত্যিককে শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর সেদিন ওখানে উপস্থিত থাকতাম । তখন অনুষ্ঠান পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন লাভপুর তারাশঙ্কর স্মৃতি সমিতি । সঙ্গে থাকতন লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতিও । আমার সাড়ে নবছরের স্থায়ীত্বকালে শেষের পাঁচ ছ বছর আমাদের দপ্তরও এই অনুষ্ঠানে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে ছিল । ভীষন মনোজ্ঞ , রুচিসম্মত , সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হত তারাশঙ্করকে । বীরভূম এবং রাজ্যের বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক , শিক্ষাবিদ , অধ্যাপকদের বৈদগ্ধপূর্ণ ভাষন শোনার জন্য মন উদ্গ্রীব হয়ে থাকত সেদিন । কাটোয়া থেকে আসতেন কবির দল । কত নতুন কাব্য গ্রন্থের প্রকাশ হত সেদিন । স্থানীয় নাট্যদলেরা পরিবেশন করতেন তারাশঙ্করের কাহিনীর ওপর কখনো " নাগিন কন্যার কাহিনী " কখনো " ডাকহরকরা " কখনো হাঁসুলী বাঁকের উপকথার" অংশ বিশেষ , কখনো বা অন্য কোনো কাহিনীর নাট্যরূপ বা শ্রতি নাটক । মনে আছে স্থানীয় বাউল শিল্পী কার্ত্তিক দাস বাউলের তারাশঙ্করকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে উদ্বোধনী সঙ্গীতগুলির কথা । কি প্রাণ ঢালা নিবেদন ছিল সে গানে । স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ , সাংস্কৃতিক কর্মী, শিশুদের ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুন্দর , সুচারু ও সুষ্ঠ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ভরে উঠত তারশঙ্করের শ্রদ্ধা তর্পনের প্রাঙ্গন । কখনো অনুষ্ঠান স্থল থাকত লাভপুর তারাশঙ্কর স্মৃতি ভবন তো কখনো ধাত্রীদেবতার প্রাঙ্গন । অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটত উপস্থিত সকলের পঙক্তি ভোজনের মাধ্যমে । সে এক অনাস্বাদিত অনুভূতি ও তার আনন্দ ভাষায় রচনা সম্ভব নয় । সকল অতিথি , কবিবৃন্দ , অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষ এবং স্থানীয় দর্শককুল । তারাশঙ্করের জন্মতিথি এনে দিত সকলের জন্য এক মহা মিলন মেলা যার মূল সুর ও রেশ ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তাঁরই রচিত অসংখ্য সাহিত্যে । এত সুন্দর সমাপ্তি আমি আর অন্য কোনো জন্ম স্মৃতি বাসরের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে দেখিনি ।
আজ আবার এক ৮ই শ্রাবণ । আবার আজ নতুন করে সব মনে পড়ে যাচ্ছে । শারিরীক ভাবে যত দূরেই থাকি মনের দিক থেকে আজও তো আমি আমার প্রিয় সাহিত্যিকের জন্মভিটেতে দাঁড়িয়েই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি । আশা রাখি পৃথিবী দ্রুত শান্ত হবে এবং পরের বার আবার আগের মতনই আমরা তাঁকে সশরীরেই শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সক্ষম হব তাঁর জন্মতিথিতে ।
Comments
Post a Comment