সেই রামায়ণের যুগ থেকে চলে আসছে নারীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। সীতাকে লঙ্কাধিপতি রাবণ হরণ করেছিল ছলনার আশ্রয় নিয়ে । তাই রাম রাবণের যুদ্ধ হলো ।। লঙ্কেশকে পরাজয় করে সীতা উদ্ধার হলো। ফলস্বরূপ সোনার লঙ্কা ছারখার হয়ে গেছিল।।
হাসিখুশি সীতামাতা তো অযোধ্যায় ফিরলেন । কিন্তু শেষরক্ষা কি হলো ? ঘরে এসেও সীতামাতাকে শুচিতার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, "অগ্নি পরীক্ষা"। হায়রে নারী !!! নীরবে সীতামাতা মেনেও নিলেন। রাজনন্দিনী হয়েও তিনি ছিলেন জনম- দুঃখিনী।।
কিন্তু দ্রৌপদী !! কৌরবসভায় যেদিন পঞ্চস্বামী ও কৌরব পক্ষের তাবড় তাবড় রাজপুরুষদের চোখের সামনে দুঃশাসন তার কেশাকর্ষণ করে রাজসভায় নিয়ে এসেছিল সেদিন সকলে নতমস্তকে বসে সেই অসহায় রাজবালার হয়ে প্রতিবাদের একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। কেন ? সেই ভয়ংকর পরিস্হিতির ঘটনা সর্বজনের সামনে ঘটেছিল। ফল কি হয়েছিল !! কুরুক্ষেত্র কৌরবদের রক্তে লাল হয়ে গেছিল। নারীর এই অপমানের মহাভারত রচনার কাল আমরা পার হয়ে এসেছি , সময় পাল্টেছে কিন্তু নারীকে লাঞ্ছনা করার প্রবৃত্তি এখনো রয়ে গেছে।।
আজ আমার সেই বিহারের প্রত্যন্ত গ্ৰামের মেয়েটির কথা বড় বেশি মনে পড়ছে । আমরা সহপাঠী ছিলাম কলেজে। পুনম এসেছিল শহরে পড়তে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা , সেদিনের সেই পুনম ছিল দলিত জাতির মেয়ে। তার গ্ৰামে রাজপুত আর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বেশি তাই কয়েক ঘর দলিত জাতির মানুষ মাথা নত করে বসবাস করতো। তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষ দলিত মেয়েটির উচ্চাশা ভালো চোখে দেখেনি। তবুও পুনম এসেছিল এক টুকরো জ্ঞানের আলো নিয়ে গ্ৰামে ফিরবে সেই আশাতে। কেউ তাকে সাহস জোগায়নি।। শুধু পুনমের নিরক্ষরা মাতামহী , তার দাদী বলেছিল," তুই চলে যা শহরে, পড়বি , অনেক পড়বি, ঐ ঘমণ্ডি লোকগুলো একটু দেখুক আমরাও পারি লেখাপড়া করতে।।" বাবা আর মা ভয়ে কুঁকড়ে গেছিল কিন্তু বাড়ির কর্ত্রীর উপর কথা বলতে সাহস করেনি। পুনম কলেজে এসে আমাদের সাথে মিলেমিশে গেছিল। কিন্তু গ্ৰামের তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকেরা রাগে ফুঁসছিল । শুধু তাই নয়। পুনমের পরিবারকে শাসিয়েছিল ।" দেখ লেঙ্গে" এইরকম একটি মনোভাব ছিল তাদের।। এরপর পুনম পুজোর ছুটিতে বাড়ি গেছিল একরাশ আনন্দ নিয়ে, কিন্তু পুজোর ছুটির শেষে সে ফিরলো না। কেন ফেরেনি আমরা জানতে পারিনি। আমরা প্রথম প্রথম জানতে চেষ্টা করেছি কেন সে ফিরলো না। জানতে পারিনি। ধীরে ধীরে তার কথা মন থেকে মুছে গেল।
বহুকাল পরে আমি তখন বিহারের একটি ছোট শহরের স্কুলে কর্মরত। আমার তখন বেশ বয়স হয়েছে। স্কুলে একজন হিন্দীর শিক্ষিকা নতুন এসেছে শুনলাম। নতুন হিন্দীর শিক্ষিকার নাম সুমন ঝা অর্থাৎ ব্রাহ্মণ । তাকে দেখেই আমি চমকে গেছিলাম। মহিলা আমার থেকে বছর দশেকের ছোট হবে। তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকায় সুমন একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। তখন আমি বললাম, "আপনাকে দেখে হঠাৎ আমার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেলো। আপনার মুখের সাথে পুনমের মুখের খুব মিল।" "পুনম" নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে সুমন বললো ,"আপনি দিদির বন্ধু ? আপনার নামটা বলবেন। দিদি ওর বন্ধুদের গল্প আমার কাছে করতো। দিদির বন্ধুদের নামের সাথে আমি পরিচিত। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি পুনমের ছোট বোন, তবে তোমার পদবী তো " ঝা" !! দলিত জাতির মেয়ের ব্রাহ্মণের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার ব্যাপারটি তখনকার দিনে বড় বিস্ময়কর ব্যাপার, তাই বোকার মত প্রশ্নটি মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। সুমন একটু হেসে বললো, "দিদি , আমি একজন ব্রাহ্মণ সহপাঠীকে বিয়ে করে জাতে উঠেছি।"
আমি হেসে বললাম, "আর তোমার পুনম দিদির কথা বলো।"
সে করুণ হেসে বললো, "দিদি বহুদিন হলো নিজেকে গঙ্গার বুকে সঁপে দিয়েছে। সে অনেক কথা। তা আজ বলতে বাধা নেই। মা, বাবা, দাদী কেউ আজ বেঁচে নেই। দিনও বদলেছে কিছুটা । আপনাকে বলবো ।"
সন্ধ্যার সময় আমার স্কুলের বাসায় বসে সুমন এক ঘৃণ্য ঘটনার কথা আর অতি সাহসী মেয়ের কাহিনী শুনিয়েছিল। মানুষরূপী পশুদের কীর্তি কলাপ আর জাতের নামে নষ্টামির কথা । আর দুজন বিদ্রোহিণীর কথা। সুমনের কথায়,
" দিদি পুজোর ছুটিতে যখন বাড়িতে এলো তখন দিদি খুব খুশি। কিন্তু বাবা আর মা যেন দিদির গ্ৰামে ফেরাটা মেনে নিতে পারছিলেন না। আমি দিদির থেকে বেশ ছোট ছিলাম , তবুও বুঝতে পারছিলাম একমাত্র দাদী ছাড়া বাড়ির আর সকলে ভয়ে ভয়ে রয়েছে। তখন তো বুঝিনি। পুজোর ছুটি তো বেশ বড়। দুর্গাপুজো শেষ হয়ে গেল । দীপাবলির পর দিদি আবার কলেজ হষ্টেলে চলে যাবে।
গ্ৰামে একটি কালীপুজো হতো সেইসময়, যেখানে দলিতদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। আমি তখন বেশ ছোট, বড় হয়ে সব কথা শুনেছি। কালীপুজোর দিন মধ্য রাতে আমাদের বাড়িতে চারজন যুবক ঢুকে দিদিকে তুলে নিয়ে গেল জবরদস্তি করে। সকলের অনুনয় বিনয়ে কোন কর্ণপাত করেনি। প্রতিবেশীরা দরজা ফাঁক করে সব দেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরের দিন দিদিকে লাঞ্ছিত করে বাড়ির দোরগোড়ায় ফেলে রেখে দিয়ে চলে গেছিল। যাবার সময় শয়তানগুলো বলেছিল মুখ বন্ধ রাখতে। সকলে হতভম্ব, ভীত । দিদি তখন অচেতন ছিল। জ্ঞান ফেরার পর বলেছিল, "আমাকে একটু বিষ দাও।" তারপর কি হলো জানিনা। আমি ছোট ছিলাম। শুনলাম দিদি বিষ খেয়ে মারা গেছে। গঙ্গার ধারে দিদির দেহ বাবা নাকি একা গিয়ে দাহ করে এসেছিলেন। ভয়ে আমি সেদিন কাঁদতেও ভুলে গেছিলাম। পরে কিন্তু জেনেছিলাম ওটা একটা eye wash ছিল। আমার দাদী খুব সাহসী মহিলা ছিলেন। লেখাপড়া শেখেননি, কিন্তু মনটা ছিল বড়, আর ছিল অদম্য সাহস। বহু দিন পরে দাদী বলেছিলেন আমাকে, "পুনি বিষ খেয়ে মরতে চেয়েছিল । তাই আমি বললাম, 'মরবি, মরার সময় এলে মরবি । তবে ঐ জানোয়ারগুলোকে মেরে মরবি।" সকলে যখন জানতো দিদি মারা গেছে, তখন দাদী দিদিকে বাড়ির গোয়ালঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পোতিকে ( নাতনি) একটু একটু করে কি গুপ্ত মন্ত্র দিচ্ছিলেন সে শুধু দিদি জানতো আর দাদী জানতো।
তারপর বছর ঘুরে আবার কালীপুজোর রাত। আমাদের তো দূর থেকে মাকে দর্শন করতে হতো। পুজো নিয়ে বাবুমশাইরা যখন মত্ত তখন দাদী দিদিকে ঘরে নিয়ে এলো। দিদিকে দেখে তো আমি অবাক। দিদি বেঁচে আছে !! রাত বাড়ছে।। গ্ৰামের পুজো । মা আমাকে জোর করে শুতে পাঠালেন। তারপরের ঘটনা পরে জেনেছিলাম। দাদী তক্কে তক্কে ছিল। পুজো শেষে মত্ত অবস্হায় সেই চারজন দুষ্কৃতি পুজোমণ্ডপে দারুর বোতল খুলে পান করতে ব্যস্ত। অতিমাত্রায় পানাসক্ত হয়ে চারজন তখন বোধশক্তি রহিত। শীত পড়েছে একটু একটু , তবুও তার মধ্যে তাদের মত্ত অবস্হায় পড়ে থাকতে দেখে দাদী তার পোতিকে নিয়ে দাঁড়ালো সেই জনহীন মণ্ডপে। সামনে করালবদনী মা কালী দাঁড়িয়ে আছেন। দাদী বললেন, "যা, এগিয়ে যা।। এই নে কুড়ুল, বসিয়ে দে গলায় ,মাথায়। ওদের হুঁস নেই।ভয় পাসনি। এতদিন তো সব শিখিয়ে দিলাম এক কোপে কি করে মারতে হয়।।" অচৈতন্য পিশাচগুলো কিছু বোঝার আগেই তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল । আমার দিদি পেরেছিল তার মাতামহীর মান রাখতে। তারপর দিদি কুড়ুল হাতে ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল । পতিতপাবনী মা গঙ্গা গ্ৰামের গা বেয়ে বয়ে চলেছেন। মা গঙ্গার বুকে ঝপাং করে একটি শব্দ শুনে দাদী নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।"
সব শুনে আমি তখন বললাম, "সে কি, তোমার দাদী তোমার দিদিকে আটকালো না ?"
সুমন বললো, "আমি দাদীকে ঐ প্রশ্নটা করেছিলাম। দাদী বলেছিলেন, 'ও তো আগেই মরে গেছিল। বেঁচে থাকলে এই সমাজ কি ওকে শান্তিতে থাকতে দিতো বল ? ঐ গ্ৰামের প্রধানরা শুধু ওকে নয়, আমাদেরও মেরে ফেলতো।' তোর দিদি পশুবলি দিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। ও যে আমার দুর্গা।"
আমি বাকহীন হয়ে সব শুনলাম। সুমন বললো, "পরের দিন গ্ৰামের বাবুমশাইরা স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। কোন দলিত শ্রেণীর মানুষ পুজোমণ্ডপে ঢুকে এতবড় মারণোৎসব করবে এটা তাদের চিন্তার বাইরে ছিল। পুলিশ এসেও খুনের সুরাহা করতে পারেনি। তবে ঐ লোকগুলো খুব ভয় পেয়েছিলো। আমার দিদি ওদের পশু আত্মার বুকে একটা আঘাত হেনে আত্মঘাতী হয়েছিল।"
সুমন অনেক কিছু বলে চলেছে। তারপর সুমন কখন চলে গেছে আমি টের পাইনি। আমার মন তখন চেতনাহীন হয়ে গেছে। আকাশের পূর্ণিমার চাঁদের আলো যখন গঙ্গার বুকে এসে মিশে যায় আর গঙ্গার বুককে আলোকিত করে তখন গঙ্গার সৌন্দর্য কেমন হয় তাই ভাবতে ভাবতে স্হির হয়ে এক ভাবে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা। আমার কি চেতনা লোপ পেয়েছিল যে রাত্রে বাইরের ঘরের দরজাও বন্ধ করিনি !! হঠাৎ দেখি পূব আকাশে সূর্যদেব উঁকি দিচ্ছেন। আঁধার পেরিয়ে দিনমণির আগমনে আমার বাড়ির আশেপাশে গাছে গাছে পাখিদের গান শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনে প্রশ্ন ওঠে এই আসুরিক শক্তি কবে শেষ হবে ? কবে পুনম ,সুমনরা সমাজে নারীর মর্যাদা নিয়ে এই সমাজে জায়গা করে নেবে !! এর জবাব পাইনি। তবে অসুর ছিল বলেই তো মহামায়ার জন্ম। ।। নারীর আর এক নাম মহাশক্তি মহামায়া।।
Comments
Post a Comment