লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি ভাঁজো ঃ----প্রসঙ্গ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও হাঁসুলী বাঁকের উপকথা - চাঁদ রায়
মহিলাদের কৃষি ব্রতের অঙ্গ স্বরূপ Fertility Cult-এর অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে ভাঁজো ব্রত। পল্লী বাংলার জীবনসংগীত বলা যেতে পারে এই ব্রতোৎসবকে। ভাঁজোকে স্থানভেদে 'ভাজুই', 'ভাজৈ' কিংবা 'ভাজ' বলা হয়ে থাকে। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে "শোস্ পাতার ব্রত" বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ভাঁজো বাঙালি হিন্দুদের একটি ব্রতাচারমূলক সারি নৃত্য। এই ভাঁজো উৎসবটি প্রাগার্য কোনো এক অনুষ্ঠান যা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তবু এর উপর আর্য প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের সঙ্গে সঙ্করায়ন করা হয়েছে। M. N. Srinivas-এর মতে, "এটি সংস্কৃতায়ন (SANSKRITIZATION) করা হয়েছে। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন---" প্রাচীন ইন্দ্রধ্বজ উৎসব ভাঁজো বা ভাজুই'-এর সঙ্গে মিশে গেছে।
আমরা সেই মিশ্র বা সংকর রূপটিই দেখে আসছি বাল্যকাল থেকে। তবে একথা সত্য যে, লৌকিক দেবদেবীর পূজা প্রচলন করেছিলেন অস্ট্রিক জাতির মানুষেরা। আর সেই সূত্র ধরে বলা যায়, 'ভাঁজো' এই লৌকিক দেবীর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন রাঢ় বঙ্গ তথা বীরভূমের গণমানুষ।
এই ব্রতোৎসব লোকছড়া ও লোকসংগীতের উৎস। ভাঁজোতলায় পরিবেশিত ছড়া ও গানগুলি নিতান্তই গ্রাম্য মহিলাদের নিজস্ব সম্পদ এবং রাঢ়বঙ্গের বহু দেশজ শব্দযুক্ত রাঢ়ী উপভাষায় ব্যক্ত। এগুলি লোকজ তথা লৌকিক সাহিত্যের মৌলিক উপাদান। এদের গঠনে থাকে সুর ও ছন্দ যার মাধ্যম রাঢ়ী উপভাষা।
এই প্রসঙ্গ ধরেই আলোচনা করতে চাই অমর কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর লেখা "হাঁসুলী বাঁকের উপকথা"কে সামনে রেখে।
সাহিত্য সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন--"তারাশঙ্কর গ্রাম্য জীবনের চারণ কবি" । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই লিখেছেন--"রাঢ় দেশের ভেতর থেকে যা কিছু সঞ্চয় করে মানুষ ও তার জীবন নিয়ে লিখেছি।"
সাহিত্য রচনায় কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বাস্তব জীবন কাহিনীর সঠিক ছবি ফুটে উঠলে তাকে বলা হয়ে থাকে স্থানিকতা বা Local Colour. তারাশঙ্করের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের মতোই অন্যতম উপন্যাস, 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' স্থানিকতা বৈশিষ্ট্যে অনন্য।
তারাশঙ্করের উপন্যাসে রাঢ়বঙ্গের লৌকিক সংস্কৃতি ও লৌকিক জীবনের প্রভাব খুব বেশি দেখা যায়। 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসে অন্যান্য অনেক লৌকিক সংস্কৃতির সঙ্গে 'ভাঁজো' লোকোৎসবের কথা ও তৎপ্রসঙ্গে লোকসংগীতের উল্লেখ আছে। আছে গ্রাম্য জীবনের সরল অকৃত্রিম কাহিনী। পাখি, করালী, নসুদিদি, বনওয়ারী ইত্যাদি গ্রাম্য চরিত্রগুলি রাঢ়বঙ্গের আটপৌরে বাস্তব জীবন ও জীবন সংগ্রামে রত অনন্য বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধি।
এখন আমরা দেখব হাঁসুলী বাঁক কী এবং কোথায় এর অবস্থান ?
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন -- কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁক আছে তার নাম "হাঁসুলী বাঁক"। মহিলারা এক ধরনের হার গলায় পরে যার নাম হাঁসুলী । অর্দ্ধচন্দ্রাকার এই গয়নাটির মতো একটি স্থলভূমিকে ঘিরে কোপাই নদীর বাঁকটিই হচ্ছে হাঁসুলী বাঁক।
এখন দেখা যাক এর অবস্থান কোথায়?
এই বাঁকটির কিছুটা দূরে বক্রেশ্বর ও কোপাই নদী মিলিত হয়েছে। বীরভূমে এই দুই নদীর মিলনের পরবর্তী অংশকে কূয়ে নদী বলে। এর নিম্নভাগ 'লাঘাটা' নামে পরিচিত যার অদূরেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভূমি লাভপুর অবস্থিত। বীরভূম জেলার লাভপুর থানায় হাঁসুলী বাঁকের অবস্থান। এই বাঁক সংলগ্ন দুটি গ্রমের নাম শ্যাওড়াপুর ও মিলনপুর।
এই হাঁসুলী বাঁকের পার্শ্বস্থ গ্রামগুলির মানুষের জীবনযাপন, দুঃখ কষ্ট, ভালো মন্দ, অকৃত্রিম সরল উৎসব, অনুষ্ঠান, বারব্রত, লোকসংস্কৃতির কথা নিয়েই তারাশঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাস, 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'। লোকজ উপাদান ও লোককবিদের কাছ থেকে রসদ নিয়ে সৃষ্ট এই উপন্যাসে লোকসংস্কৃতির অন্যতম ভাঁজোর কথা ও গানের উল্লেখ আছে।
এই উপন্যাসের অংশ বিশেষ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
# হাঁসুলী বাঁকের উপকথা# উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায়ে আছে -- বনওয়ারী হুকুম দিয়েছে, বেবাক 'যোবতী' অর্থাৎ যুবতী কাহার-কন্যে-বউকে এবার নাচতে হবে আসন্ন ভাঁজো পুজোয়। সুবাসীও নাচবে। পাগল চাষের সময় পালিয়েছিল, ভাঁজোর আগের দিন এসেছে। ভাঁজো পুজোয় সমগ্র কাহারপাড়া মেতে উঠেছে। হাঁসুলী বাঁকে তারা গান গাইছে------
কোন ঘাটেতে লাগায়েছ 'লা'
ও আমার ভাঁজো সখি হে !
আমি তোমায় দেখতে পেছি না
তাই তো তোমায় খুঁজতে এলাম হাঁসুলীর ই বাঁকে --
বাঁশবনে কাশবনে লুকালছ কোন ফাঁকে !
ইশারাতে দাও হে সখি সাড়া
তোমার আ-ঙা পায়ে লুটিয়ে পড়ি গা
ও আমার ভাঁজো সখি হে।
করালী এনেছে হারমনি, বনওয়ারীর দলে এসেছে সানাই। দু দলের প্রতিযোগিতা দেখার মতো।
ভাঁজো লো সুন্দরী, মাটি লো সরা
ভাঁজোর কপালে অঙের সিঁদুর পরা
আলতার অঙের ছোপ মাটিতে দিব
ও মাটি, তোমার কাছে মনের কথা বলিব,
পঞ্চ আঁকুড়ি আমার ধর লো ধরা।
সবাই মিলে কোপাই-এর ঘাট থেকে ঘট ভরে আনে পাঁচ আঁকুড়ির সরা মাথায় নিয়ে। নতুন করে রং করা পুরানো কাপড়গুলি রঙের গাঢ়তায় ঝকঝক করছে। চিরকাল কাহারপাড়া আর আটপৌরে পাড়ায় ঝগড়া। এবার হচ্ছে কাহারপাড়ার সঙ্গে করালীর দলের ঝগড়া। মুখে মুখে গান বেঁধে গেয়ে গালাগালি। এ গালের মধ্যে শাপশাপান্ত নাই। এ রঙ্গরসের গাল। কোপাই-এর ঘাটে একদফা গালাগালি হয়ে গেল।
তারপর পাড়ায় ফিরে আপন আপন এলাকায় নাচ আর গান। প্রথমে বয়সওয়ালা মেয়েরা নাচতে শুরু করে। ভাঁজোর পরম সুখের দিন। ওদিকে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে করালী। সুবাসীর মন সেই দিকে। পাগল গান ধরেছে অঙের গান। পাগল ভাঁজোর মধ্যে নিজ মনের কথা প্রকাশ করে।
যে অঙ আমার ভেসে গেল,
কোপাই নদীর জলে হে !
সে অঙ যেয়ে লেগেছে সই
লালশালুকের ফুলে হে !
( কোপাই নদীর জলে হে ! )
সেই শালুকে মন মানালাম
সকল দুখো পাসরিলাম
তোমার মনের অঙের মলা
তুমিও দিয়ো ফেলে হে
( কোপাই নদীর জলে হে ! )
নিত্য নতুন ফোটে শালুক
বাসি ঝ'রে গেলে হে
(কোপাই নদীর জলে হে)
Comments
Post a Comment