বছরের সেই দিনটি সবার খুব প্রিয় হয়, যেদিন সে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে এই পৃথিবীর আলো দেখেছিল। সবাই কতো আনন্দই না করে ---বন্ধুদেরকে নিয়ে কেউ হইহুল্লোড় করে, কেউ পার্টি দেয়, আবার পথের পাশে পড়ে থাকা শিশুটা মায়ের হাতের এক চামচ পায়েস খেয়েই খুশি হয়। তবে আজ যে জন্মদিনের কথাটা আমি সবার সাথে ভাগ করে নেব সেটা একটু আলাদা। এই জন্মদিন আনন্দের, নাকি দুঃখের, নাকি বিরহের, নাকি জীবনের চরম ভালোবাসার ! সেটা পাঠকবর্গ না হয় বিচার করে নেবেন।
ঘটনার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের, চাকরি সূত্রে তখন আমি কলকাতায়।আমার পাশের বাড়িতে থাকতো তমালদা ও তাঁর সদ্য বিবাহিত গিন্নি কাবেরী। তমালদা চাকরি করতো ইন্ডিয়ান আর্মিতে, বাড়িতে তমালদার স্ত্রী কাবেরী একাই থাকতো, প্রতিবছর মাস দুইয়ের জন্য তমালদা ছুটি নিয়ে আসত। কখনো পুজোর সময় তো কখনো শীতে। বাড়িতে একা থাকতে থাকতে নিজেকে অসহায় বোধ করত কাবেরী বৌদি আর তাই নিজের পড়াশোনার সার্টিফিকেটগুলোকে হাতিয়ার করে কলকাতার একটি নামকরা অফিসে অফিসার পোস্টে জয়েন করে। সেবার পুজোর সময় তমালদা যখন বাড়ি ফিরল বাড়িতে আনন্দের শেষ নেই, হই-হুল্লোড় লেগে আছে। কখনো বন্ধুদেরকে নিয়ে পার্টি, তো কখনো অফিসের স্টাফদের নিয়ে। তমালদা পাড়ার সবার খুব প্রিয় ছিল, ক্লাবে এসে আড্ডা মারা, ক্যারাম খেলা ,পাড়ার অসহায় ছেলে-মেয়েদের বই খাতা পেন কিনে দেওয়া, কতকিছুই না করত।
একদিন সকালে হঠাৎ ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে, একটু বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি সামনে তমালদা ও বৌদি । আমি তাঁদের ভেতরে আসতে বললাম আর ডাইনিং রুমে সোফায় সবাই মিলে বসলাম, ভোলাকে ডেকে বললাম সবার জন্য চা করতে। তমালদা বলে উঠলো "নিলয়, আজ খুব তাড়া পরে কোন একদিন চা খাব, আসল কথায় আসি, আজ আমার জন্মদিন তাই ভাবছি সবাইকে নিয়ে একটু আনন্দ করবো। আমাদের কেয়ারটেকার স্বপনদাকে বলে রেখেছি। সন্ধ্যেবেলায় একটু আসিস ভাই।"
আমি কি করব বুঝে উঠতে না পেরে বললাম, ঠিক আছে যাব, কিন্তু জন্মদিনে শুধু মুখে বাড়ি থেকে ফিরে যাবে তা তো হয় না, একটু মিষ্টিমুখ অন্তত করো, আর সাথে চা-টাও খেয়ে যাও। এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোলা মিষ্টি ও চা নিয়ে হাজির, গল্প চলতে থাকে চায়ের টেবিলে, কিছুক্ষণ পর তমালদা ও বৌদি বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার আগে আবার বলে যায়, "যাস কিন্তু ভাই ভুলে যাস না।" আমি নিশ্চিত করলাম, ঠিক আছে যাবো ভুলবো না।
দিনটি বেশ ভালোই কাটলো। পুজোর ছুটি শেষে তমালদা আবার যথারীতি চলে গেল নিজের কর্মস্থলে। যাবার আগে বলে গেল, "ভাই, বৌদি একা থাকলো, কখনো কোনো দরকার হলে একটু দেখিস।"
বেশ ভালই যাচ্ছিল দিনগুলো, বৌদিও নিজের কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ,আমারও আর বিশেষ খোঁজ নেওয়া হয়নি। দেখতে দেখতে সাত-আট মাস কেটে গেছে। মাঝেমধ্যে বৌদির সাথে কখনো ফ্লাটের সিড়িতে বা ফ্লাটের মিটিংয়ে দেখা হয়েছে, সামান্য কিছু কথা ও হাসি বিনিময় এভাবেই চলে যাচ্ছিল বেশ। দিনটা শুক্রবার, অফিসে এই দিনটায় বেশ কাজের চাপ থাকে। দুপুরে টিফিন করতে বেরোলাম যখন চারিদিকে একটাই খবর কাশ্মীরে পহেলগাঁও-এ নাকি আতঙ্কবাদীরা ইন্ডিয়ান আর্মিদের বেশ কয়েকটি গাড়ি শক্তিশালী মিশাইল দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। দেশের সৈনিকদের এভাবে মারা যাওয়ায় চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। আমিও যথারীতি অফিসের কাজ সেরে বাড়ি এসে টিভিটা চালিয়ে বসেছি, হঠাৎ মনে পড়ে আমাদের তমালদাও তো কাশ্মীরে ছিল ! একবার বৌদির কাছে গিয়ে খোঁজ নিইতো, তমালদা কেমন আছে ? তমালদার বাড়ির বাইরে গিয়ে কলিং বেলটা টিপলাম, বৌদি বেরিয়ে এলো, দেখে মনে হল মনে একরাশ চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তমালদা ফোন করেছিল ?বৌদি বলে ওঠে, দুদিন আগে করেছিল, বলল কি একটা ডিউটিতে অনেক দূর যেতে হবে সেখানে নাকি ফোনে নেটওয়ার্ক থাকেনা। এদিকে আজকে এই দুর্ঘটনাটা মনের ভেতরটায় কেমন একটা কু-ডাক দিচ্ছে । আমি বৌদিকে বলি, ওসব কিছু ভেবোনা, তমালদা ভালই আছে নিশ্চয়। বৌদি উপরের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। আমিও চলে আসি।
রাত্রি নটা নাগাদ ইন্ডিয়ান আর্মির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সংবাদমাধ্যমে দুর্ঘটনায় নিহতদের নাম ঘোষণা করে, টিভিতে খবরটা চলছিলই, হঠাৎ একটা নাম উঠে আসতেই আমি চমকে উঠি -- পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার তমাল চক্রবর্তী নিহত, বয়স বত্রিশ বছর। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। খবরটা বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র আর্তনাদ ও চিৎকার কানে আসতেই আমি ছুটে যাই ওপরে, গিয়ে দেখি কাবেরী বৌদি প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছে। আমি কোনক্রমে তাকে সামলাই, আর তাদের বাড়ির সকলকে খবর দিই, রাতেই সবাই চলে আসে। কয়েকদিন পর তমালদার কফিনবন্দি দেহ আমাদের পাড়ায় আসে, আমরা সবাই সম্মানের সাথে তমালদার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি।
এরপর বেশ কিছুদিন বৌদি বাড়ি থেকে আর বেরোয়নি, অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা মাস কেটে যায়, বৌদি আবার নতুন করে নিজের চাকরির জায়গায় যোগদান করেছে। হঠাৎ একদিন বৌদি একটি চিঠি নিয়ে আমার কাছে হাজির। চিঠিটা তমালদা বৌদির উদ্দেশ্যে লিখেছিল, শেষবার যখন এসেছিল পুজোর সময় তার কিছুদিন পর।চিঠিটা পড়ে আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম, যা বুঝলাম তমালদা নিজের জীবন নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল, তাই লিখেছে "আমার মৃত্যুর পর কাবেরী তুমি নিজের জীবনটাকে নষ্ট করো না, কলেজের বন্ধু সুশান্তকে নিজের জীবনসঙ্গী করে নিও।" এদিকে বৌদি হাউমাউ করে কাঁদছে, এও কি সম্ভব নিলয়? আমি তমালকে কি করে ভুলে যাব ? নতুন কাউকে কি করে নিজের করে নেব ?
আমরা অনেক করে বৌদিকে বোঝাই, তমালদার শেষ ইচ্ছে তো এটাই ছিল, তুমি মেনে নাও । যাই হোক এরপর বৌদি নিজের ভালোবাসার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে। আগের মতই চলতে থাকে আবার সেই জীবনযাত্রা ।আমিও কাজের চাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, এদিকে পুজো এসে গেছে। পুজোতে বেশ আনন্দই হলো। তমালদার নামে একটা অরগানাইজেশন খোলা হল, যেখান থেকে প্রতি বছর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হবে। দেখতে দেখতে পুজোটা কেটে গেল, আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজের কর্মজগতে। একদিন সকালে হঠাৎ আবার সেই কলিংবেলের আওয়াজে ঘুমটা ভাঙলো । দরজা খুলে দেখি কাবেরী বৌদি। আমি জিজ্ঞেস করি, বৌদি কিছু বলবে ? বৌদি বলে ওঠে, আজ তমালের জন্মদিন, সন্ধ্যেবেলায় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি, একটু এসো, ভালো লাগবে । আমি বলি বেশ যাব, অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি নিলাম । মনের মধ্যে বিষন্নতা কাজ করছে -- যে নেই , আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল, সেই
তমালদার আজ জন্মদিন। গত বছর এই দিনটায় কতই না আনন্দ করেছিলাম। আর আজ ? যাইহোক অফিস থেকে ফিরে কোনরকমে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে তমালদার বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম, গিয়ে দেখি বাড়িতে প্রচুর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে। মাঝখানে একটি বড় টেবিলের ওপর একটি কেক, আর সামনে তমালদার একটি ছবি, মোমবাতি জ্বলছে। এরপর বৌদি ঠিক সন্ধে সাতটায় মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটে আর তমালদার ফটোর সামনে একটা কেকের টুকরো তুলে ধরে বলে ওঠে, শুভ জন্মদিন তমাল, যেখানেই থাকো ভালো থাকো। তারপর ছোট ছোট শিশুদের নিজের হাতে কেক খাইয়ে দেয়। আর সাথে সাথে নিজের নতুন জীবনসঙ্গীর মুখে তুলে দেয় কেক। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সুশান্তের দিকে, ,দেখলাম সুশান্ত নিজেও খুব আনন্দের সঙ্গে তার জীবনসঙ্গিনী কাবেরীর সাথে তমালের জন্মদিন পালন করছে। মনে মনে ভাবলাম এও কি সম্ভব ? ভগবানের উদ্দেশে একটাই প্রার্থনা জানালাম "ভগবান এই ভাবেই যেন আমাদের দেশের প্রতিটি শহীদ সৈনিকের জন্মদিন পালন হয়। দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় এই ভাবেই যেন তাঁরা অমর হয়ে থাকে সকলের হৃদয়ে।"
Comments
Post a Comment