আমার নাট্যজীবনে প্রথম বাঁকবদল এসেছিল 'সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ'র হাত ধরে। প্রায় ওই একই সময়ে, সম্ভবত ১৯৮৭ সালে, এলো দ্বিতীয় বাঁক। এর আগে প্রধানত ফটিকবাবু অর্থাৎ ডাঃ বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রতিকৃতিতে মাল্যদান প্রভৃতির মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপিত হতো। সেবার বড় করে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হলো। ৮ই শ্রাবণের আগের দিন এলেন দিদিভাই পত্রিকার সন্তু সেনগুপ্ত, তাঁর সঙ্গে বিজয় কুমার দাস, আদিত্য মুখোপাধ্যায় ও চন্দ্রমোহন সিংহ। পরদিন কলকাতা থেকে এলেন উমাশঙ্কর হালদার, যিনি হলধর পটল ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতেন। তিনিই ছিলেন সেদিনের প্রধান বক্তা। তারাশঙ্করের কনিষ্ঠ পুত্র সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তো সস্ত্রীক ছিলেনই। এছাড়া সিউড়ি থেকে প্রবীণ সাংবাদিক রমানাথ সিংহ, অধ্যাপক কৃষ্ণনাথ মল্লিক, কিশোরী রঞ্জন দাশ সহ সারা বীরভূমের সকল সাহিত্যসেবী এবং তারাশঙ্করপ্রেমীরা সেদিন সকালে এসে জড়ো হলেন তারাশঙ্করের বৈঠকখানা বা 'ধাত্রীদেবতা'য়। বক্তৃতা, স্মৃতিচারণ, গান সবই হলো। আর আমরা পরিবেশন করলাম শ্রুতিনাটক 'রাইকমল'।'রাইকমল'-এর নাট্যরূপ আমারই দেওয়া। এর পর থেকে প্রতি বছরই আমরা তারাশঙ্করের জন্মদিনে একটি করে শ্রুতিনাটক করেছি। সাল তারিখ মিলিয়ে হিসেব করে বলতে পারবো না। তবে বিভিন্ন বছরে করেছি কালিন্দী, পাটুনী, দেবতার ব্যাধি, চণ্ডী রায়ের সন্ন্যাস, কলকাতার দাঙ্গা ও আমি ( পাপমুক্তি ), নাগিনী কন্যার কাহিনী প্রভৃতি। নাগিনী কন্যার কাহিনী যে বছর হয় সে বছর এসেছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করুণাসিন্ধু দাস। উপরের নাটকগুলি সবই আমার নাট্যরূপ দেওয়া। এছাড়া ছিল আমোদপুর সাহিত্য সংসদের সত্যেন্দু মুখার্জির নাট্যরূপ দেওয়া বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং তারিণী মাঝি। তারাশঙ্করের কয়েকটি গল্প নিয়ে 'তারাশঙ্কর পরিক্রমা' নামে একটি শ্রুতি-আলেখ্যও আমরা করেছিলাম ধাত্রীদেবতায়। এটি বেতারেও প্রচারিত হয়েছিল। এর আগে ১৯৭৬ কি ৭৭ সালে অন্যান্য যাত্রাপালার সঙ্গে বাজার থেকে কেনা বই দিয়ে তারাশঙ্করের 'গণদেবতা' পালাটি করেছিলাম। ৮৭ সালে তারাশঙ্করের জন্মজয়ন্তী পালনের সময় থেকে তাঁর গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে শুরু করলাম নিজেরাই। শুধু ছোট শ্রুতিনাটকই নয়, বড় মঞ্চনাটকও লিখলাম।সাতাশি সালের ৮ শ্রাবণ সন্ধ্যায় অতুলশিব মঞ্চে হয়েছিল 'পঙ্খে' নাটকটি। এটির নাট্যরূপ এবং নির্দেশনায় ছিলেন আমোদপুর সাহিত্য সংসদের সত্যেন্দু মুখার্জি। শশাঙ্ক সরকার করেছিল পঙ্খে চরিত্রটি। পরে করেছিলাম তারাশঙ্করের কবি। এটিরও নাট্যরূপ সত্যেন্দুবাবুর দেওয়া। এ নাটক লাভপুর, পুরন্দরপুর এবং আরো অনেক জায়গায় হয়েছিল। আর হয়েছিল কলকাতার শিশির মঞ্চে। শিশির মঞ্চে নাটক দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তৎকালীন ভূমি সংস্কার মন্ত্রী শ্রদ্ধেয় বিনয় চৌধুরীকে। তিনি সময়ের আগেই শিশির মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন, নাটক দেখেছিলেন এবং প্রশংসাও করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন ধীরেন সেন এবং রামচন্দ্র ডোম।তারাশঙ্করের 'ধাত্রীদেবতা' উপন্যাসটিকে দুভাগ করে দুটি নাটক লিখেছিলাম এক সময়। প্রথমটির অনেক পরে লেখা হয়েছিল দ্বিতীয়টি। প্রথমটির নাম ছিল ধাত্রীদেবতা, দ্বিতীয়টির নাম দিয়েছিলাম 'শিবনাথ' । হাঁসুলীবাঁকের উপকথা উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে শুরু করি সুপ্রভাত মিশ্রের তাগাদাতে। বোলপুর ছাড়াও এ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল লাভপুর, পুরন্দরপুর, সিউড়ি, মুর্শিদাবাদের মহলান্দী, কান্দি, বহরমপুর রবীন্দ্র সদন, নগর হাই স্কুল, বর্ধমান রবীন্দ্র সদন, হাওড়া শরৎ সদন এবং কলকাতার পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। কলকাতায় সল্ট লেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তারাশঙ্করের ভাইপো অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়।তারাশঙ্করের নিজের লেখা কালিন্দী নাটকটিও আমরা একসময় করেছিলাম দিশারী সাংস্কৃতিক চক্রের প্রযোজনায়। নাটকটিকে কেটেছেঁটে কিছু পরিবর্তন করে বর্তমানের অভিনয়োপযোগী করে দিয়েছিল পার্থপ্রদীপ সিংহ। নির্দেশনা বা পরিচালনায় ছিল সুপ্রভাত মিশ্র। আমি করেছিলাম রামেশ্বরের চরিত্রটি।নাটকের শেষে একটি গান ছিল, "ও কালিন্দীরে, একূল ভেঙে ওইকূলে তুই গড়লি কেন চর।" গানটি সুপ্রভাতেরই লেখা। সবশেষে এটি ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতো। গানটি গেয়েছিল কার্তিক দাস বাউল। এ নাটকের সংগীত পরিচালনায় ছিল সৈয়দ আবসার হোসেন (টুসুন)। আনন্দবাজার পত্রিকার সেসময়ের জেলা প্রতিনিধি অরুণ মুখোপাধ্যায় লাভপুরে আমাদের 'কালিন্দী' সম্পূর্ণ দেখেছিলেন এবং সে নিয়ে খুব বড় করে লিখেছিলেন আনন্দবাজারে।
পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করে সাহিত্য সৃষ্টি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তা দৃষ্ট। বলা বাহুল্য, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চাইতে কবিতাতেই এই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার বেশি। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি পৌরাণিক নানান অনুষঙ্গকে কবিরা ব্যবহার করছেন। আমরা আজ আলোচনা করব নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের মেলবন্ধন কিভাবে তাঁর কবিতাকে সামগ্রিকতা দান করেছে। নজরুল তাঁর অনেক কবিতাতেই এই পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথকে এক নতুন ভাবে রূপদান করেছেন। তিনি পুরাণের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কবিতায় স্থাপন করতে চেয়েছেন। বলা যেতে পারে, পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার তাঁর কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি হিন্দু, মুসলিম, গ্রীক প্রভৃতি পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্য কবিতায় এক নতুনভাবে ব্যবহার করেছেন। আমরা সেগুলোই এখন আলোচনা করে দেখে নেবো। নজরুলের কবিতায় পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যের ব্যবহারকে আমরা কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে নেবো। ১। ভারতীয় মিথ-পুরাণের ব্যবহার। ২। বা...
Comments
Post a Comment