রাঢ় বাল্মীকি তাঁর আমার কালের কথায় লিখছেন– " সাতন পণ্ডিত আমার ইস্কুল জীবনের প্রথম শিক্ষক । আমি প্রায়ই তাঁর কথা মনে করি । কখনো কখনো এই সকরুন জীবনকাহিনী নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভাবি কিন্তু বুঝতে পারি না, তাঁর এই দুর্ভাগ্যকে কোন ব্যাখ্যানে ব্যাখ্যা করব ? জন্মান্তরের কর্মফল ? অদৃষ্টের পরিহাস ? সে আমি পারি না । তাঁর জীবনের ইতিহাসের অন্ধকারে ডুবে -- তাঁর চরিত্রের যে ছিদ্রপথে এ পাপ ঢুকে তাঁর জীবনটাকে এমন ছিন্নভিন্ন করে দিলে তাকে আবিষ্কার করতে সাহস পাই না আমি । তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি --- ভালোবাসি, তাই তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে উপন্যাস রচনার অভিপ্রায় মন থেকে মুছে ফেলেছি ।"
সেদিন ছিল বিজয়া দশমী । প্রতিবছর লাভপুর সহ পঞ্চগ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষ এই দিন অপরাহ্নে ফুল্লরা মহাপীঠে আসে অন্তরের প্রণাম নিবেদন করতে । প্রণামের পর মাংস-মুসুরির প্রসাদ গ্রহণও দীর্ঘদিনের প্রথা । বাবার সঙ্গে গেছি । সেখানে একটি মানুষকে মন্দিরের আটচালায় বাবা প্রণাম করলেন । তাঁকে আমি চিনি না চিনতাম তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে তিনি বাবার বাল্যবন্ধু পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁকে বাবা আলিঙ্গন করলেন । আমিও দুজনকেই প্রণাম করলাম । বাবা সে বছর আদর্শ শিক্ষক হিসাবে রাজ্যস্তরে পুরস্কার পেয়েছেন । কথা প্রসঙ্গে সেকথা বলতেই সৌম্যদর্শন মানুষটি বললেন তুমি পাবে না সন্ন্যাসী ? তুমি যে সাতন পণ্ডিতের নাতি । তিনিও শেষ জীবনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে আদর্শ শিক্ষকের সম্মান পেয়েছিলেন । তোমাদের বাড়ি আমার গুরুর গুরু পরম গুরুর বাড়ি । তারপর আমরা বনকুলের ঝোপের পাশদিয়ে মতিবাবুর আমবাগানের ভিতর দিয়ে উঠলাম লাইনের ধারে । মেঘ মুক্ত শরতের আকাশ ----মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুলগুলি দুলছে । ছোট লাইনের ট্রেনটা ধুঁয়ার আলপনা এঁকে পেরিয়ে গেল । মানুষ দুটিও লাল মোরামের পথ ধরে মিলের পাশ দিয়ে চলে গেল । বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম সাতন পণ্ডিতদের কথা বললেন উনি কে ? বাবার কাছে জানলাম উনি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । এর পর বহুদিন পেরিয়ে গেছে বাবাও চলে গেছে ! সব স্মৃতি আবছা ধূসর ! সাতন পণ্ডিতের বহু গল্প বাবার কাছে শুনেছি । গল্প গুলোও যে সত্যি তা প্রমাণ দেওয়ার মানুষ গুলিও আজ জীবনের পরপারে ! তাই সাহিত্যিকের চোখেই তাঁকে দেখার চেষ্টা করি। সাতন মিশ্র ( সতীশ চন্দ্র মিশ্র ) আর তারণ মিশ্র ছিল দুই ভাই । বড় ভাই তারণ মিশ্র তদানীন্তন জমিদার ষষ্ঠীকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমিদারি দপ্তরে ম্যানেজার ছিলেন । তিনি ম্যানেজারবাবু নামে পরিচিত ছিলেন । সকাল বেলা বাবুদের ঘোড়ার গাড়ি এসে তাঁকে নিয়ে যেত সন্ধ্যায় দিয়ে যেত । তাঁর ভাল নাম ছিল তারাপ্রসন্ন মিশ্র । তাঁর একমাত্র কন্যা রজতবরণীর কনিষ্ঠ পুত্র আমার বাবা । আর ভাই সাতন ছিলেন লাভপুরের কুইন্টন প্রাইমারী ইস্কুলের শিক্ষক । বর্তমানে যেখানে লাভপুরের গ্রামীণ হাসপাতাল । পূর্বদিকে ছিল বিদ্যালয়টি ।
তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে তারাশঙ্কর লিখছেন– " তাঁর অনুকরণে আমার ছোট নাতি দুষ্টুমি করলে বড় নাতির মাথায় চড় বসিয়ে দি । সে বলে - ওই আমি কি করলাম ? আমি বলি তুমি দেখবে । তুমি দেখবে ।"
" বহু কৃতিজন তাঁর ছাত্র । তিনি যখন তাদের সঙ্গে সম্ভ্রমে কথা বলতেন আমি লজ্জা পেতাম । এই মানুষটির শেষ বয়সটা বড় সকরুন । কল্পনাতীতভাবে সকরুন । অন্নবস্ত্রের কষ্টে সকরুণ নয় । সেদিক দিয়ে তাঁর বিশেষ কষ্ট ছিল না । মধ্যবিত্ত গৃহস্হ -- জমি ছিল , বাগান ছিল । কিন্তু বিচিত্র বিস্ময়কর পথে এল তাঁর জীবনের বিয়োগান্ত পরিণতি । তাঁর দুটি ছেলে শ্রীধর আর সুদাই অর্থাৎ সুদর্শন । শ্রীধরকে ম্যাট্রিক পাশ করালেন । সুদাইও পড়ছিল ।
কিন্তু দেখা গেল দুটো ছেলেই নেশাখোর হয়ে উঠেছে। শেষে পথে ঘাটে সমাজে তারা নেশায় প্রমত্ত হয়ে বেড়াতে লাগল। গাঁজা খেয়ে শ্রীধরের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেল। আমাদের গ্রামের মহাপীঠ ফুল্লরা তলায় গাঁজাখোরদের আসরের সভ্য হল । সে আসরে মহাপীঠের মহন্ত গদীয়ান থেকে শ্রীধর পর্যন্ত দশ বারোজন সভ্য । সকলেই অর্ধোন্মাদ । ষাট বছর থেকে তেইশ চব্বিশ বছরের শ্রীধরকে নিয়ে উদার সভা । এই সভার আসরে পারা ঘৃতকুমারীর শাঁস এবং আরও কিছু মিশিয়ে তামাকে সোনায় পরিণত করবার বিচিত্র পরীক্ষা চলত । এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক করতে করতে শ্রীধর একখান চেলাকাঠ আর একজন গঞ্জিকাসেবীর মাথায় দিলে বসিয়ে; ফলে তার মাথাটা চুর হয়ে গেল। আদালতে শ্রীধর সবিস্ময়ে বললে ---- এত নরম ওর মাথা । সে আমি জানতাম না ।
দায়রা আদালতে বিচার হল -- সেখানেও শ্রীধর ওই কথা বললে আর ফিকফিক করে হাসলে । শ্রীধরের সে পাগলের হাসি অকৃত্রিম । শ্রীধর বেকসুর খালাস পেল ।
ওদিকে সুদাই তখন দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে। বাপকে বাড়িতে পীড়ন করে -- পয়সা দে , গাঁজা খাব । বয়স তার তখন তের কি চৌদ্দ । বোধ হয় ক্লাস সেভেনে পড়ে । প্রহার করে বাপকে । গ্রামের পথে পথে বাপের অযোগ্যতা ঘোষণা করে বেড়ায় । --- যে বাপ গাঁজা খাবার পয়সা দিতে পারে না ছেলেকে সে কেমন বাপ ?
বাড়িতে পণ্ডিত মশাই মাথা হেঁট করে মৃত্য কামনা করে । মাথা হেঁট করে পথ চলেন । হঠাৎ যেন সুদিন এল । ঊনিশো ত্রিশ সাল । মহুগ্রামের মিটিংয়ে সুদাই এগিয়ে এল । বললে -- আজ থেকে আমি নেশা ছাড়লাম । সত্যি নেশা ছাড়লে সুদাই । শুধু এখানেই শেষ নয় । সুদাই আরো দুটি সমবয়সীর সঙ্গে ঊনিশো ত্রিশ সালের আন্দোলনে আমাদের ওখান থেকে গ্রেফতার হল ।
স্টেশনে সেদিন সে কি জনতা । সুদাইদের সে কি অভিনন্দন জানালে । ফুলের মালা গলায় নিয়ে , ললাটে চন্দন - তিলক নিয়ে তারা চলে গেল । সেদিন বৃদ্ধ পণ্ডিতের চোখে দেখেছিলাম জল , মুখে সে কি হাসি । ঠোঁট দুটি হাসি কান্নায় থর থর করে কাঁপছিল ।সুদাই তিন মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে গেল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে । সেখানে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ছিলেন তখন । তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তিনটি ছেলের উপর । তাদের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন । যত্ন করেছিলেন । স্নেহ দিয়েছিলেন । সুদাই ফিরল সগৌরবে । তখন আমি জেলে । আমি যখন জেল থেকে ফিরলাম তখন আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে ।
পুলিশের নিষ্ঠুর নির্যাতনে দেশটা ভরে মূক হয়ে গেছে । বন্দেমাতরম উচ্চারণ করতেও কেউ সাহসী হয় না । এই অবস্হায় একদিন পণ্ডিতের সাথে দেখা হল । পণ্ডিত কাঁদলেন ঝরঝর করে কেঁদে বললেন --- আমার অদৃষ্ট দেখ বাবা । সুদাইটা আবার নেশা ধরেছে । আগের থেকে অনেক বেশি নেশা করছে । আমাকে ধরে মারছে । আমার অদৃষ্টেই বোধ হয় এতবড় আন্দোলন সব মিছে হয়ে গেল । ব্যর্থ হয়ে গেল । "
সাতন পণ্ডিত মারা গেল তেতাল্লিশ সালের মহামারিতে । স্ত্রীসহ মারা গেল শ্রীধর সুদাই ও এক কন্যা । রইল শুধু শ্রীধরের স্ত্রী ও তার দুই পুত্র অনাদি ও সুকুমার । দ্বিতীয়া কন্যা ভোলাদাসীকেও আবার দ্বিতীয়বার তুলে দিলেন হেলারামের হাতেই । যিনি তারাশঙ্করের বন্ধু ও যাদবলাল উচ্চবিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন । মাটির মানুষ সাতন পণ্ডিত যে শিব কালীর মন্দিরে আজীবন পূজো করতেন সেই মন্দির তাঁর সুযোগ্য ছাত্র দেব কুমার চন্দ্র ও ডাঃ সুকুমার চন্দ্র দালান করেছেন । আজও কালীর নিত্যপূজার ব্যয়ভার তিনি বহন করে চলেছেন । আজও আজও পণ্ডিতের পইনাতি উজ্জ্বল মায়ের আটনে পূজো করে । সে রকমই ----" কপালে সিঁন্দুরের ফোঁটা , হাতে ফুলের পাত্র । "
Comments
Post a Comment